আদালতের রায়ে টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের মেয়র পদ থেকে বহিষ্কৃত এবং ৫ বছর নির্বাচনে নিষিদ্ধ থাকা লুৎফুর রহমান আসন্ন টাওয়ার হ্যামলেটস মেয়র নির্বাচনে আবারও প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ভোট জালিয়াতিসহ ৭টি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা ভোগ করার পর লুৎফুর রহমানের আবারও মেয়র প্রার্থী হওয়াকে চরম নৈতিকতা বিবর্জিত এবং নির্লজ্জ কাজ বলে অভিহিত করেছেন মামলার পিটিশনার ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব আজমল হোসেন। অতীত কর্মকাণ্ড এবং আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়ে লুৎফুর রহমানকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তিনি।
গেল ৮ মার্চ মঙ্গলবার ব্রিক লেইনের প্রেমপ্রীতি রেস্টুরেন্টে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ আহবান জানানো হয়। নির্বাচনী অনিয়মের যে মামলায় লুৎফুর রহমান সাজা পেয়েছেন, সেই মামলার খরচ আদায় সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি অবহিত করতেই এই সংবাদ সম্মেলন। ওই মামলার অন্যতম একজন পিটিশনার কমিউনিটির সুপরিচিত ব্যক্তি ও ব্রিক লেইনের ব্যবসায়ী আজমল হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন স্থানীয় বাংলা টাউনের বাসিন্দা কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব আমির হোসেন, সাবেক কাউন্সিলার আলা উদ্দিন ও ডেবিট স্যীমন। সংবাদ সম্মেলনে আজমল হোসেন জানান, মামলায় হেরে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে লুৎফুর রহমান নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করায় মামলার খরচ আদায়ে বেশ সময়ক্ষেপন হয়েছে। রিসিভার লুৎফুর রহমানের ২টি বাড়ি বিক্রি করে অবশেষে সেই অর্থ আদায় করেছে। দীর্ঘ প্রায় ৭ বছর পর পিটিশনাররা মামলার খরচ ফেরত পাচ্ছেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে রিসিভিার পিটিশনারদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
২০১৪ সালে টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট নামে একটি দলের প্রার্থী হিসেবে লুৎফুর রহমান দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে ভোট জালিয়াতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে। পরবর্তীতে চারজন পিটিশনার এ নিয়ে মামলা করেন। সেই মামলায় লুৎফুর রহমান ভোট জালিয়াতিসহ ৭টি অপরাধে দোষী সাব্যস্থ হন। তাঁর রাজনৈতিক দল টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্টের আয়-ব্যায়ের কোনো হিসাবও আদালতকে দেখাতে পারেননি লুৎফুর রহমান।
আদালত তাঁকে মেয়র পদ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কার করে এবং ৫ বছরের জন্য নির্বাচনে নিষিদ্ধ করে। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে সলিসিটর রেগুলেটর অথোরিটি (এসআরএ) লুৎফুর রহমানের সলিসিটর লাইসেন্সও কেড়ে নেয়। ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর লুৎফুর রহমান এখন আবারও মেয়র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর সলিসিটর লাইসেন্স এখনও ফেরত পাননি।
সংবাদ সম্মেলনে আজমল হোসেন বলেন, লুৎফুর রহমান আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। আপিলে তিনি হেরে যান এবং তাঁর সাজা বহাল থাকে। কিন্তু এখনও তিনি ও তাঁর সমর্থকরা সবকিছুকে ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন। তিনি বলেন, আদালতে বিচার এবং আপিলেও সাজা বহাল থাকার পর আর তো কোনো যুক্তি চলে না। ব্রিটেন তো থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি নয় যে, বিচারে প্রভাব খাটানো যায়। অথচ আদালতের রায় মানিনা বলে তারা ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। এটা দুঃখজনক।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, লুৎফুর রহমান তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো অপরাধের প্রমাণ পায়নি বলে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন। বাস্তবতা হলো ব্রিটিশ নির্বাচনী আইন-১৯৮৩ এর ১৭৩ ধারা অনুযায়ী ইলেকশন কোর্টে লুৎফুর রহমান যেসব অপরাধে সাজা পেয়েছেন সেগুলো ‘সিভিল অফেন্স’(দেওয়ানী)। তাঁর অপরাধের ধরণ বিবেচনায় বিচারক মাউরি ‘ক্রিমিনাল অফেন্সে’(ফৌজদারী) লুৎফুর রহমানকে আরও সাজা দেয়া উচিত কি-না, সেটি খতিয়ে দেখতে লন্ডন পুলিশকে নির্দেশ দেন।
ফলে লুৎফুর রহমান দফায় দফায় লন্ডন পুলিশের তদন্তের শিকার হন। তবে সময়মতো ও ধারাবাহিক প্রমাণ সংরক্ষণে পুলিশি ব্যর্থতায় ক্রিমিনাল অফেন্সের সাজা থেকে রেহাই পেয়ে যান তিনি। যে কারণে লন্ডন পুলিশ তদন্তের শিকার হয় এবং নিজেদের ব্যর্থতা শিকার করে দুঃখপ্রকাশ করে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, পুলিশ ক্রিমিনাল অভিযোগ আনতে পারে নাই বলে লুৎফুর রহমান ‘নির্দোষ’হয়ে গেলেন? তিনি সিভিল অফেন্সে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মেয়রপদ থেকে বহিষ্কার এবং রাজনীতিতে ৫ বছর নিষিদ্ধ হয়ে শাস্তি ভোগ করেছেন। শাস্তির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেও হেরেছেন।
তাঁর সলিসিটর লাইসেন্স কেড়ে নেয়া হয়েছে। দুটি মামলার খরচ দিতে না পেরে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছেন। যে কারণে তার দুটি বাড়ি নিলামে বিক্রি করে ওই অর্থ আদায় করা হয়। ক্রিমিনাল অফেন্সে আরও শাস্তি পান নাই বলে তিনি নির্দোষ? চুরিতে ধরা পরায় তারা আমার এক কান কাটছে, দুই কান তো আর কাটতে পারে নাই-ব্যাপারটা এমন হয়ে গেল না? লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, লুৎফুর রহমান তাঁর তিনটি বাড়ি মামলার খরচের জন্য বণ্ড দিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করায় ওই তিনটি বাড়ির ওপর চার্জ বসানো হয়। তখন তাঁর স্ত্রী একটি বাড়ি নিজের বলে দাবি করেন।
কিন্তু বাড়ি কেনার অর্থ কোথায় পেলেন- এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। তখন লুৎফুর রহমানের তৎকালীন ব্যাংক স্টেইটম্যান্ট উপস্থাপন করে আইনজীবী আদালতকে বলেন, ওই বাড়ি কিনতে লুৎফুর রহমান তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে ৬৪ হাজার পাউন্ড তার স্ত্রীকে দিয়েছিলেন। ফলে আদালত ওই ৬৪ হাজার পাউন্ড ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়। যা তিনি ইতমধ্যে দিয়েছেন।সবমিলিয়ে ১১ লাখ ১৫ হাজার পাউন্ড আদয় করেছে রিসিভার। এ টাকা থেকে আদালতের খরচ, আইনজীবীদের খরচ এবং অন্যান্য আনুসঙ্গিক খরচ পরিশোধ করা হচ্ছে। মামলার বাদি হিসেবে আজমল হোসেন তাঁর খরচ ও সময়ের মূল্য বাবদ পাচ্ছেন ৮৪ হাজার ৮৫০ পাউন্ড। এনডি অ্যালেন পাচ্ছেন ৩৭ হাজার পাউন্ড।
ডেবি সিমন্ডস পাচ্ছেন ১২ হাজার পাউন্ড। আজমল হোসেন বলেন, বাড়ি সংক্রান্ত শুনানীতে আরও বেরিয়ে আসে, লুৎফুর রহমান একজন সলিসিটর হওয়া স্বত্বেও মর্গেজ নিতে গিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। বাড়ি ভাড়ার ইনকাম কখনো এইচএমআরসিতে প্রদর্শন করেননি। বছরের পর বছর ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা লুৎফুর রহমানের নির্বাচনী অনিয়ম বিষয়ে বিচার চাইতে আদালতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন যে এতটা নৈতিকতা বিবর্জিত তা আমাদের কল্পনাতেও ছিলো না।তিনি বলেন, সাংবাদিক ভাই-বোন সহ সকল সচেতন বাসিন্দাদের প্রতি আমার অনুরোধ – আপনারা সাজাপ্রাপ্ত লুৎফুর রহমানকে চ্যালেঞ্জ করুন- জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার কি নৈতিক অধিকার তার আছে? বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তিনি উপযুক্ত কি-না? তার কারণে সমস্ত মিডিয়ায় টাওয়ার হ্যামলেটস এবং এখানকার বাঙালিরা আবারও নেতিবাচকভাবে সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে।
বাঙালির মান-সম্মান নষ্ট করার অধিকার তাঁকে কে দিয়েছে? টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালির ভোটকে পূঁজি করে লুৎফুর রহমানের যে স্বতন্ত্র রাজনীতি, তা আমাদের কমিউনিটির বিশাল একটি অংশকে মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আমাদের অনেক সম্ভাবনাময় তরুণের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে নষ্ট করে দিয়েছে। শাস্তি ভোগের পরও লুৎফুর রহমান বলছেন, তিনি এ রায় মানেন না। ব্রিটেনের আইন-আদালতের প্রতি লুৎফুর রহমানের যদি কোনোই আস্থা না থাকে তাহলে তিনি কীভাবে টাওয়ার হ্যামলেটস পরিচালনা করবেন। তাঁর নেতৃত্বে টাওয়ার হ্যামলেটসের বাসিন্দারা কেন আইন মেনে চলবেন? অতীত ইতিহাস কখনো কথার মারপ্যাঁচে আর গায়ের জোরে মোছা যায় না।
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply