রাজধানীর সূত্রাপুরে অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামানের বাসায় আড্ডা দেয়ার সুযোগ হয়েছিল বেশ কয়েকবার। তখন আক্ষেপ করে তিনি বলতেন, ‘আমার সেরা অভিনয় দর্শক এখনো দেখতে পায়নি। সব সময় চেয়ে ছিলাম সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় করতে। কিন্তু পরিচালকরা আমাকে পর্দায় উপস্থাপন করেছেন বানরের মতো। যেন এ টি এম মানেই লাফাবে আর রসিকতা করবে’। সে দিন তিনি হলিউড, বলিউড আর ঢালিউডের যে ইতিহাস বলে ছিলেন, তা শুনে মনে হয়েছিল চলচ্চিত্রের উইকিপিডিয়ার সামনে বসে আছি।
সিনেমায় গ্রামগঞ্জের মহাজনেরা যেভাবে গদি পেতে বসতেন। এ টি এম শামসুজ্জামানের বসার ঘর সে রকমভাবেই সাজানো ছিল। এত জানাশোনা মানুষটি লেখক হলেন না কেন? প্রশ্ন শুনে তিনি হাসি দিয়ে বলে ছিলেন, দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে আমার অনেক লেখা প্রকাশ হয়েছে, কিন্তু অভিনয়ের টানে ওটা আর সিরিয়াসলি নেয়া হয়নি। তবে আমার ইতিহাসসমৃদ্ধ বই পড়তে ভালো লাগে। এখনো সুযোগ পেলেই বই নিয়ে বসি। এত জানাশোনা খোলামনের মানুষটি শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সূত্রাপুরে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। পর্দায় নেতিবাচক চরিত্রে খ্যাতি পাওয়া মানুষটি বাস্তব জীবনে অনেক ধার্মিক ছিলেন। এ কারণেই জীবদ্দশায় বলে গিয়ে ছিলেন, মৃত্যুর পর যেন তাকে দ্রুত দাফন করা হয়। পরিবার তার সেই কথা রেখে শহীদ মিনার ও এফডিসিতে তার লাশ নেয়া থেকে বিরত ছিল।
তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন শোবিজ অঙ্গনের পাশাপাশি সমাজের নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষ।
অনেকেই বলেছেন, সেরা অভিনয় করতে না পারার আক্ষেপ থাকলেও এ টি এম শামসুজ্জামান যা দিয়ে গেছেন তার জন্যই বাংলা চলচ্চিত্র তাকে মনে রাখবে সব সময়। নাট্যব্যক্তিত্ব তারিক আনাম খান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমি ভাবতে চাই না এ টি এমের আগের চরিত্রে কী দেখেছি, পরের চরিত্রে কী দেখব। কিন্তু ইফ ইট ইজ বিলিভেবল অ্যান্ড হি ক্যান মেইক ইট, দর্শককে বিশ্বাস করানো যে এই লোকটা এত খারাপ! আমার মায়েদের দেখেছি, উনি স্ক্রিনে আসার সাথে সাথে এমন বলতেন, উনি বিচ্ছিরি লোক! আমার মনে হয়, অভিনেতা হিসেবে এ টি এম শামসুজ্জামানের সার্থকতা এখানেই। যখন যে চরিত্রে কাজ করেছেন সেটাকেই প্রাণবন্ত ও বাস্তবভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন।
এ টি এম শামসুজ্জামানের সেরা অভিনয় করতে না পারার দুঃখ সম্পর্কে তারিক আনাম বলেন, আমাদের নির্মাতারা বিশেষ করে মূলধারার চলচ্চিত্রের সাথে যারা আছেন, তারা খুব পরিবর্তন দেখাতে চান না বা দেখাতে পারেন না। এ টি এম ভাইও সে অর্থে চরিত্রে পরিবর্তন আনতে পারেননি, টেলিভিশনেও তাকে আমরা একই রকম চরিত্রে দেখেছি। উনি খুব ভালো একজন লেখক ছিলেন, যেটা আমাদের চলচ্চিত্র জগতে খুব কম এসেছে। শেষবার ওনার সাথে যখন দেখা হয়েছে উনি আমার বাড়ির নিচে এসেছিলেন এবং একটা গল্প লেখার কথা বলছিলেন। এক ধরনের অসহায়ত্ব একজন শিল্পীরও থাকে। তাকে করে খেতে হয়, খুব বেশি বাইরে যাওয়ার অবকাশ থাকে না এবং ইন্ডাস্ট্রিতেও সেভাবে সুযোগ থাকে না। সংশপ্তকে সে সময়ে তার রমজানের গেটআপ চিকন একটা মোচ, চোখের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে, মনে হয় যেন একটা তরঙ্গ। এইটা খুব দরকার। শাইখ (নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ) স্যারের কথা বলার একটা স্টাইল ছিল। এ টি এম ভাই সে কথা বলার স্টাইল নকল করতে করতে তার ক্যারেক্টারের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন। আমরা তখন মজা করে বলতাম আপনি তো শাইখ স্যারের একদম সাগরেদ হয়ে যাচ্ছেন। উনি বলতেন এটা আর না করে থাকতে পারি না, ঢুকে গেছে ভেতরে। অর্থাৎ তিনি যা চাইতেন তাই পারতেন।
নির্মাতা, প্রযোজক ও সমালোচক জসীম আহমেদ বলেন, এটিএম শামসুজ্জামানের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, তিনি এমন পরিচালক এবং ছবি পাননি- যা দিয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দেবেন। প্রমাণ করবেন যে, এই পৃথিবীতে তার সময়ে যে দু’ চারজন বিরল অভিনয়শিল্পী জন্মেছেন তাদেরই একজন তিনি। জসীম আহমেদ বলেন, ২০ বছর আগে টেলিভিশন সিরিজ নির্মাণের জন্য এ টি এম শামসুজ্জামানের সাথে দীর্ঘ আলোচনা হয়ে ছিল। একটা টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য ড্রামেডি (ড্রামা ও কমেডি) ঘরানার গল্প ভেবেছিলেন তিনি। কোরবান আলী ও তার পরিবারের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড। প্রতি পর্বে থাকবে আলাদা আলাদা গল্প। যতদূর মনে পড়ে, ‘কোরবান আলীর রোজ নামছা’ নাম দিতে চেয়েছিলেন। কোরবান চরিত্রে তিনি নিজে অভিনয় করবেন, শর্ত ছিল চ্যানেলের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর করা হয়নি। তবে সে দিনের আলোচনায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম তার সেন্স অব হিউমার-এর সাথে সেন্স অব বিউটির কি দুর্দান্ত সমন্বয়। চিত্রনাট্যের সেটআপ, কনফ্রন্টেশন এবং রেজুলেশন বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য অসাধারণ। তিনি শুধু সেরা অভিনেতা নন- একাধারে গল্পকার, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক। তার সাথে কাজ করা মানে আমাদের মতো নবীনদের জন্য সত্যিকার অর্থেই সেরা শিক্ষা।
অভিনেত্রী ববিতা বলেন, এ টি এম শামসুজ্জামান ভাইকে চিন্তাম অভিনয়ে যুক্ত হওয়ার আগে থেকে। প্রথম দেখা হয়েছিল সুচন্দা আপার বাসায়। সব সময় হেসে কথা বলতেন। ওনার সাথে গোলাপী এখন ট্রেনে, নয়নমণি, ম্যাডাম ফুলির মতো জনপ্রিয় সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ হয়। শুটিং স্পট থেকে শুরু করে বাসায় বাইরে অনেক জায়গায় আমরা আড্ডা দিয়েছি। সব সময় তার সাথে কথা বললে যেকোনো টেনশন দূর হয়ে যেত। আমার কাছে সব সময় মনে হতো তিনি চরিত্রের মধ্যে আছেন। সব সময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করতেন তিনি। এ টি এম ভাই শিশুর মতো একজন ভালো মানুষ ছিলেন। নির্মাতারা চাইলে তাকে আরো অনেকভাবে ব্যবহার করতে পারতেন।
তবে কার ধারা কতটুকুন সম্ভব ছিল সে হিসাব বাদ দিয়ে প্রাপ্তির খাতা খুললেও একজন এ টি এম শামসুজ্জামান অনেক উপরেই থাকবেন।
কিংবদন্তির মৃত্যু নেই। তিনি বেঁচে থাকবেন রূপদান করা চরিত্র- যেমন ‘নয়নমণি’র মোড়ল, ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’র জোবেদ ফকির, ‘গেরিলা’র তসলিম সর্দার, ‘দায়ী কে’-এর কদম আলী এবং এমন অসংখ্য ছবির অগণিত চরিত্রের ভেতর। স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার লেখা গল্পে, তৈরি করা চরিত্র ও দৃশ্যে।
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply